বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ ও প্রতিকার অনেকেরই অজানা। আমরা অনেকেই জানি না Top Road Accident Causes and Solutions in Bangladesh .
সড়ক দুর্ঘটনা !!! প্রধান প্রধান কারণ!!!
২৫০০০ মানুষের মৃত্যু!!! হ্যাঁ, আপনি ঠিকই দেখছেন। ২৫ হাজার!!!
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ ও প্রতিকার
সম্প্রতি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্টে প্রকাশিত হয় সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২৫০০০ মানুষের মৃত্যু হয়। তারমানে হচ্ছে গড়ে প্রতিদিন ৬৮ জনেরও অধিক মানুষ সড়কে মারা যাচ্ছেন। যার মধ্যে আবার ৫১% হচ্ছেন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। (সূত্রঃ ঢাকা ট্রিবিউন, ২২ অক্টোবর, ২০২৩)
কি ভয়ঙ্কর অবস্থা ! প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার হার প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে। একটি গাড়ির চলন্ত অবস্থায় তার পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকে গাড়ির চালকের হাতে, তাই বলা যায় ড্রাইভিং এর সময় কিছু বিষয়ে গাড়ির চালকের সচেতনতা ও সতর্কতা দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে দিতে পারে।
Top Road Accident Causes and Solutions in Bangladesh
১। গাড়ির ফিটনেস ও কার্যক্ষমতাঃ
রাস্তায় নিরাপদে চলার জন্য আপনার গাড়িটিকে সর্বপ্রথম নিরাপদ রাখুন। গাড়ির প্রয়োজনীয় সার্ভিসিং ও কারিগরি ত্রুটি সঠিক সময়ে ঠিক করান। ইঞ্জিনের কন্ডিশন, ব্রেক ও স্টিয়ারিং সিস্টেমের অবস্থা, টায়ারের কন্ডিশন ইত্যাদি সঠিকভাবে মেইন্টেইন না করলে চলন্ত রাস্তায় বিপদে পরতে হতে পারে।
গাড়ির ফিটনেস বা কারিগরি কোন ত্রুটির কারনে যেন সড়কপথে কোন বিপদের সম্মুখীন হতে না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরী। ত্রুটিপূর্ণ গাড়িকেও ফিট দেখিয়ে রাস্তায় নামাবেন? আপনি কার সাথে চালাকি করছেন? একটু ভেবে দেখেছেন কি কতটা ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছেন গাড়ি, গাড়ির চালক ও গাড়ির ব্যবহারকারীদের? হতে পারে এই গাড়ি আপনি নিজে বা আপনার পরিবারের সদস্যগণ ব্যবহার করেন।
তাই সঠিক স্থানে দক্ষ মেকানিকের মাধ্যমে গাড়ির মেইন্টেন্যান্স করান ও সঠিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করুন।
২। গাড়ির অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিং
বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা গাড়ি ও যানবাহনের অতিরিক্ত বা নিয়ন্ত্রনহীন গতির জন্যই ঘটে। আমরা অনেক সময় মনে করি সড়কের বাঁকগুলিতে দুর্ঘটনার হার বেশি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাঁকা রাস্তার চেয়ে সোজা রাস্তায় দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। সড়ক বিভাজক দিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঠেকানো যায়, কিন্তু প্রচন্ড গতিতে ওভারটেকিং এর সময় ঘটা দুর্ঘটনা ঠেকানোর উপায় কী? এ বিষয়ে চালকের সচেতনতা ও নিরাপদ গতিতে গাড়ি চালানোর বিকল্প নেই।
ড্রাইভিং এর সময় মনে রাখা জরুরীঃ
“যত গতি, তত ঝুঁকি”।
স্টিয়ারিং যদি থাকে আপনার হাতে,
ধৈর্যকে হবে সঙ্গী বানাতে।
৩। গতির নিয়ন্ত্রন
শুধু বেশি গতি নয়, কিছু ক্ষেত্রে গতি কমানোও হতে পারে দুর্ঘটনার কারণ। কীভাবে? পেছন থেকে আসা বাহন ও তার গতির দিকে খেয়াল না করেই যদি হঠাত চলন্ত গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়া হয়, কিংবা থামিয়ে ফেলা হয় গাড়ি, তাহলেও মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। যা হতে পারে প্রাণঘাতীও। অর্থাৎ, নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য চালকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন থাকতে হবে গাড়ির গতির উপর।
৪। ড্রাইভারের অমনোযোগ
গাড়ি ড্রাইভ করার সময় চালকের সম্পূর্ণ মনোযোগ গাড়ি ও রাস্তার উপর থাকা জরুরী। মনে রাখা প্রয়োজন যে মানুষ এক সাথে একাধিক দিকে ফোকাস করতে পারেনা। গাড়ি চালানোর সময় গাড়ি ও রাস্তার উপর ফোকাস রাখা কতটা জরুরী তা আমরা বুঝতে পারছি। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে যদি একজন চালক ফোনে কথা বলতে থাকেন বা অন্য কাজ করতে থাকেন এবং তার ফোকাস ঐ দিকে সরে গেলেই দুর্ঘটনার ভয়ংকর ঝুঁকিতে পরে যায় সেই গাড়িটি।
ফোন ছাড়াও রাস্তায় অন্য মানুষ কিংবা পশুর অবাধ বিচরন, অত্যাধিক বড় ও আলোকোজ্জ্বল বিলবোর্ড, অপর পাশ থেকে আলোর বিচ্ছুরন ইত্যাদির কারনেও ড্রাইভারের মনোযোগ ব্যাহত হতে পারে। দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে ড্রাইভিংয়ের সময় এসব ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।
৫। সিটবেল্ট
চলন্ত গাড়িতে সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। এই নিয়ম না মানলে জরিমানা করার বিধান রয়েছে। সিট বেল্ট বেধে গাড়ি ড্রাইভ করা এবং গাড়িতে বসা নিরাপদ চলাচলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে সরাসরি দুর্ঘটনা রোধ করা না গেলেও, জানমালের ক্ষতি কমানো যাবে। তাই গাড়ি ড্রাইভ করার সময় গাড়ির চালক সহ যাত্রীদেরও সিটবেল্ট বেঁধে রাখা জরুরী।
৬। প্রতিযোগিতার মনোভাব
সড়কপথ কোন রেসিং ট্র্যাক নয়। এই কথাটি সবাই জানলেও, মানতে ভুলে যান অনেকেই। প্রতিযোগিতা করতে চান আশে পাশের গাড়ির সাথে। কিংবা জেদ ধরে ফেলেন যে, সামনে থাকা গাড়িটিকে আমার টেক্কা দিতেই হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনাতেই শেষ হয় এই রেসের ফলাফল। ড্রাইভার নিজে হতাহত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ করেন নিজেরসহ অন্যান্য বাহন ও জানমালের। বুঝতেই পারছেন, দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে চাইলে গন্তব্যে পৌঁছানোর রাস্তায় প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ঝেড়ে ফেলতে হবে মাথা থেকে।
৭। অদক্ষ ড্রাইভিং
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটি গুরুতর সমস্যা যা প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে। রাস্তাঘাটের অপরিকল্পিত অবস্থা, যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, এবং ড্রাইভারের অসতর্কতা এই দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অনেকে ড্রাইভিং ঠিকমত না শিখেই গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। গাড়ি চালনায় দক্ষতা অর্জন ছাড়া সড়কপথে গাড়ি নিয়ে নামার ফলাফল যে কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা বিপদে পড়ার আগ পর্যন্ত অনেকেই অনুভব করেন না। গাড়ি চালানোর আগে অর্জন করতে হবে পরিপূর্ণ দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস।
৮।বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ ও প্রতিকার
ট্রাফিক আইন ও সংকেত না মানলে ব্যবস্থা আছে কঠিন শাস্তি ও জরিমানারও। সবুজ বাতিতে গাড়ি চলবে, লালে থেমে যেতে হবে, হলুদ বাতিতে অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্বজুড়ে রাস্তায় ট্রাফিকের এই নিয়ম কার্যকর থাকলেও, বাংলাদেশে দৃশ্যপট কিছুটা। ট্রাফিক লাইট আছে ঠিকই। কিন্তু সেটা মান্য করে রাস্তায় চলার প্রচলনটা কমই এদেশে। অনেক জায়গায় তো বন্ধ কিংবা অকার্যকর হয়ে আছে লাইট। তবে লাইট কাজে না আসলেও রাস্তায় রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশরা কিন্তু যানবাহনের সুশৃঙ্খল চলাচল নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে নিরলসভাবে। মনে রাখতে হবে, দায়িত্ব শুধুই ট্রাফিক পুলিশ কিংবা সিগনাল লাইটের না। নিজের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, ড্রাইভিংয়ের সময় সচেতন হতে হবে ট্রাফিক আইনগুলো নিয়ে।
ট্রাফিক সিগনাল লাইটের নির্দেশনা মেনেই এগোতে হবে সড়কপথে। অথবা দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ এর নির্দেশনা মানতে হবে। সিগনাল লাইট বা পুলিশের থামার নির্দেশনা অমান্য করে গাড়ি ছুটিয়ে যদি এগিয়ে যাওয়া মানে প্রাণের ঝুঁকি নেয়া।
রাস্তায় যদি গতিসীমা নির্ধারণ করে দেয়া থাকে তা মেনে চলতে হবে। এছাড়াও রাস্তায় স্পিড ব্রেকার, ইউ টার্ন, বাঁক, মসজিদ, হাসপাতাল কিংবা স্কুল থাকলে তা খেয়াল করে ও ঐ সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে গাড়ি ড্রাইভ করতে হবে।
৯। অপ্রস্তুত বাঁক নেয়া
কোন রাস্তাই সোজা একভাবে চলতে থাকে না। সেখানে ডানে, বামে বাঁক, ইউটার্ন থাকবেই। অমনোযোগী ভাবে নিশ্চিন্তে গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকলেন, আর সামনে হঠাত কোন বাঁক চলে এলে অপ্রস্তুত অবস্থায় হুট করে গাড়ি টার্ন করতে গেলেন। এভাবেই বড় বড় দুর্ঘটনাগুলি ঘটে।
ড্রাইভিংয়ের সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে চাইলে, রাস্তার বাঁক, ইউটার্ন গুলি দেখে শুনে খুব সাবধানে এবং যথাসময়ে গাড়ির ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে অপরকে সতর্ক করে তবেই পার করতে হবে। একই পরামর্শ রাস্তায় লেন পরিবর্তন করার ক্ষেত্রেও।
১০। উলটো দিকে ড্রাইভ
রাস্তায় ড্রাইভিং হল ধৈর্যের পরীক্ষা। অনেক সময় গন্তব্য খুব কাছাকাছি থাকলে ইউটার্ন না নিয়ে শর্ট কাটে গন্তব্যে পৌছাতে অনেকে উল্টা পথে ড্রাইভ করতে করতে এগিয়ে যান। এভাবে ঘটে প্রচুর দুর্ঘটনা। মনে রাখতে হবে “উল্টা পথের বাহন, দুর্ঘটনার কারণ”। ইউটার্ন যতই দূরেই হোক, সামান্য সময় বাঁচাতে আপনার জীবন কেন বাজি রাখছেন? মনে রাখুন আপনার পরিবার পরিজন আপনার ফেরার অপেক্ষায় আছেন।
সড়ক দুর্ঘটনা আগেও ছিলো, এখনো আছে। ভবিষ্যতেও হয়ত থাকবে। তবে এটা প্রতি বছর বাড়ার যে প্রবণতা তা খুবই চিন্তার কারণ। নিজেদের সামান্য সচেতনতা ও সতর্কতা দিয়ে আমরাই পারি সড়কপথের এমন ভয়ংকর সব দুর্ঘটনা ও হতাহতের হার কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে। যেসব উপায়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব তা সম্পর্কে জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।
শেষকথা
দুর্ঘটনায় মৃত্যু আমরা কেউই দেখতে চাই না। আমাদের অতি প্রয়োজনীয় বা শখের গাড়িগুলো যেন অকাল মৃত্যুর কারণ না হয়।
যেহেতু একটি গাড়ির চলন্ত অবস্থায় তার পুরো নিয়ন্ত্রণটাই থাকে গাড়ির চালকের হাতে, সেই হিসেবে বলা যায় ড্রাইভিং এর সময় বেশ কিছু বিষয়ে গাড়ির চালকের সচেতনতা ও সতর্কতাই দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে অনেকাংশে।
সকলের পথচলা নিরাপদ হোক এই কামনা করছি।